অবহেলা

 দশ বছর বয়সে অবহেলার কারণে যে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম।আজ বারো বছর পর আবার সেই সে বাড়ির দিকেই রওনা দিচ্ছি।বাবা-মা বেঁচে থাকার পরও এতিমের মতো থাকতে হতো।কোন অপরাধ না করেও মার খেতে হতো।দিনের পর দিন এইভাবে অবহেলা,অনাদরে আর অত্যাচারে কারণে একসময় বাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম।


বাবা-মা, বড় ভাই তানিম, আমি আর ছোট্ট জান্নাতকে নিয়ে ছিলো আমাদের ফ্যামিলি।ছয় বছর বয়সে ছোট্ট বোন জান্নাত সুইমিংপুলের পানিতে পড়ে মারা যায়।অবশ্য সেটা আমি দেখিনি দাদুর কাছ থেকে শুনেছি।কিন্তু কেন জানি আমি সেটা বিশ্বাস করতে পারিনি?কারণ আমার জানামতে জান্নাত সুইমিং পুলের কাছে যেতে ভয় পেতো।জান্নাত কখনো একা একা সুইমিং পুলের কাছে যেতে না।সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে জান্নাত এর মৃত্যুর পর আমাদের বাড়িতে যে কাজ করতো রহিম মামা তাকে দেখতে পাইনি।দাদির কাছে জানতে পারলাম সে তার গ্ৰামের বাড়িতে চলে গেছে।


আব্বুর পকেট থেকে টাকা চুরি করতো ভাইয়া আর দোষ চাপিয়ে দিতো আমার উপর। ভাইয়া যতোবার টাকা চুরি করে আব্বু  ততোবার  আমাকে মেরেছে।এমনকি আমার জন্য আম্মু গায়ে ও হাত তুলেতো।প্রতিবার ভাইয়া কোন অপরাধ করলে সেটা দোষ উপর চাপিয়ে দিতো আমার উপর। আর আব্বু আমাকে মারতো সত্যিটা বললেও আমাকে কেউ বিশ্বাস করতো না।ভাইয়া পড়ালেখায় ভালো হয় সবাই ভাইয়াকে অনেক বিশ্বাস করতো।যার কারণে আব্বু,ভাইয়ার পাশাপাশি আম্মুর অবহেলাও দিন দিন বাড়তে লাগলো।এইসব সহ্য করতে না পেরে দশ বছর বয়সে কোন এক রাতে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিলাম।


বাড়ি থেকে পালিয়ে খুলনা চলে গিয়েছিলাম। সেখানে এতিমখানায় থেকেছি প্রায় এক বছর।একদিন সন্ধ্যার পর এক অচেনা মহিলা কি বাঁচাতে গিয়ে গুলি লেগে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায়।যখন জ্ঞান ফিরে চোখ খুলে দেখি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি।আর আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে তিন জন লোক।


মহিলাকে চিনতে পারলেও বাকি দুজনকে চিনতে পারিনি। কিছুটা ভয়ে ওনাদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ কারণ মহিলার সাথে থাকা লোকটির গায়ে সেনাবাহিনীর পোশাক ছিলো।হঠাৎ করে  মহিলা বলো,  তুমি ভয় পেয়ো না বাবা। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে তোমার হাতে গুলি লেগেছে।ওনি হচ্ছে আমার স্বামী শরিফ আহমেদ একজন আর্মি অফিসার, আর ও হচ্ছে আমার মেয়ে ফারহানা।


শরিফ আহমেদ - তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ বাবা আমার স্ত্রীর জীবন বাঁচানোর জন্য। তোমার জন্য আজ আমার স্ত্রী মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে এসেছে।তোমার এই ঋণ কীভাবে শোধ করবো আমি নিজেও জানিনা।তোমার মা অনেক ভাগ্যবান যে তোমার মতো একটা সন্তান জন্ম দিয়েছি।


ফারিয়া - ভাই তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আমার আম্মুকে বাঁচানোর জন্য।তুমি না থাকলে হয়তো ছোট্ট ভাইয়ের মতো আমার মাকেও মেরে ফেলতো ওরা।


শরিফ আহমেদ - ঠিক তোমার বয়সী ছিলো আমাদের ছেলে শুভ।দুই মাস আগে স্কুল থেকে ফেরার পথে ওরা আমার ছেলে মেরে ফেলে।আর আজকে আমার স্ত্রী কে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু তোমার জন্য আজকে আমার স্ত্রী ওদের হাত থেকে বেঁচে গেছে। তোমার এই ঋণ আমি কোনদিন পরিশোধ করতে পারব না।


তানভীর -আরে আঙ্কেল এটা আমার দায়িত্ব ছিলো।ওনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে ঠিক একই কাজ করতাম আমি।এখন আমাকে এখান থেকে বের হওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। এমনিতেই আমার অনেক দেরি হয়ে গেছে আমাকে চলে যেতে হবে।


মহিলাটি - তুমি কি বলছো এইসব? তোমার হাতে,পায়ে ব্যান্ডেজ করা এই অবস্থায় তুমি একা একা বাসায় যাবে নাকি?তোমার বাসায় ঠিকানা দাও আমি তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি।


তানভীর - আন্টি আমি এতিমখানায় থাকি।পৃথিবীতে আপনজন থেকেও নেই।আপনি এখান থেকে বের হওয়ার ব্যবস্থা করে দিন।আমি একাই চলে যেতে পারবো কোন সমস্যা হবে না।


শরিফ আহমেদ - তোমার মা-বাবা কেউ নেই?


তানভীর - থাকলে কি আর এতিমখানায় থাকতাম?


আমার কথা শুনে দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে হঠাৎ করেই মহিলাটি বললো, কে বলেছে তোর মা-বাবা নেই?আজ থেকে আমরাই তোর মা-বাবা।বলেই মহিলা কি আমাকে জড়িয়ে ধরলো। 


শরিফ আহমেদ - আজকের পর থেকে নিজেকে কখনো এতিম বলে দাবী করবি না।এখন থেকে তুই আমাদের সাথে থাকবে এবং আমাদের সন্তানের পরিচয়ে।


তারপর তারা আমাকে তাদের বাসায় নিয়ে যায়।নিজের ছেলের মতোই আমাকে আদর যত্ন করে।যেটা আমি আমার পরিবারের কাছ থেকে কখনো পায়নি।আমিও তাদেরকে নিজের পরিবারের চোখেরই দেখি।ফারহানা আপু ও আমাকে অনেক ভালোবাসে।কেউ আমাদের দেখলে বুঝতে পারবেনা।আমি ওনাদের সন্তান নয় কিংবা ওনারা আমার মা বাবা না।


শুভর মৃত্যুর তিন মাস আমরা সবাই ঢাকায় চলে যায়।সেই থেকে ঢাকায় বড় হয়েছি আমি।মাএ এক মাস হয়েছে সেনাবাহিনীর সিক্রেট টিমে জয়েন করেছি।এর মধ্যেই খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম দাদির নাকি ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে।মূলত দাদির সাথে দেখা করার জন্যই এতো বছর পর নিজের বাড়িতে আসলাম।শুধু দাদির সাথে দেখার জন্য না বাবা নামক অমানুষটার সাথে পুরনো কিছু হিসাব বাকি আছে।


গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির অবস্থা থেকে কিছুটা অবাক ও হয়ে গেলাম। কারণ পুরো বাড়ি অনেক সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে কারো বিয়ে আজকে।কিছুক্ষণ বাড়ির চারদিকে তাকিয়ে থেকে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করালাম।


 ভিতরে গিয়ে যেই দাদির রুমের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম মনে হলো পেছন থেকে কেউ আমার ব্যাগে ধরে রেখেছে। পিছনে ঘুরে দেখি আমার বয়সী একটা মেয়ে কিছুটা রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।


তানভীর - সমস্যা কি আপনার?


মেয়েটি - ও হ্যালো।সমস্যা আমার নাকী আপনার?তখন থেকে দেখছি বাড়ির চারদিকে কেমন ভাবে তাকিয়ে আছেন? আবার বিয়ে বাড়িতে এসেছেন কাঁদে ব্যাগ নিয়ে।মতলবটা কি আপনার বলুন তো?


তানভীর - কি বলতে চাচ্ছেন আপনি?


মেয়েটি - আচ্ছা বাদ দেন ।আগে বলেন কোন পক্ষ আপনি?মেয়ে পক্ষ নাকি ছেলে পক্ষ কোনটা?


তানভীর - কোন পক্ষ নয়।(বিরক্তিকর ভাবে)


মেয়েটি - কোন পক্ষ নয় মানে কি? তাহলে এই বাড়িতে এসেছেন কেন?


তানভীর - কী বলছি কানে পৌঁছায় নি নাকি কানে কম শোনেন কোনটা?যতসব ফালতু।


মেয়েটি - আপনার সাহস তো কম নয় আমাকে ফালতু বলেন আপনি?আগে বলেন কেন এসেছেন এই বাড়ি তে তারপর এখান থেকে যেতে দিব?(রেগে গিয়ে)


তানভীর - দাদির সাথে দেখা করতে এসেছি হয়েছে। ব্যাগটা ছাড়ুন এবার।(কিছুটা রেগে)


মেয়েটি - দাদি কে আপনার দাদি?


তানভীর - এই মেয়ে কে তুই? যে তোকে সব কিছু বলে তারপর এই বাড়িতে প্রবেশ করতে হবে।অনেকক্ষন ধরে সহ্য করছি আর না।ভালোই ভালোই বলছি ব্যাগ ছাড়।(জুরে ধমক দিয়ে)


ইতিমধ্যে আমাদের দুজনের মধ্যে কথাকাটাকাটি দেখে বাড়ির অনেক মেহমান আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।সেই দিকে দুজনের মধ্যে কারো কোনো খেয়াল নেই। হঠাৎ করে আরেকটা মেয়ে এসে বললো,রুহি কি হচ্ছে এইসব?আপু তোকে ডাকছে চল আমার সাথে।


বলেই মেয়েটার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল।চলে যাওয়ার সময় রুহি  আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো কিন্তু কিছু বললো না। মেয়েটি চলে যাওয়ার পর কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা দাদির রুমে দিকে রওনা দিলাম।


দাদির রুমে যাওয়ার আগেই পকেটে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো।ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নিলয় যা বললো শুনে কি করবো এই মূহুর্তে কিছু বুঝতে পারছি না।জানতাম নিলয় মিমি নামে একটা মেয়েকে ভালোবাসে কিন্তু সেটা যে আমার চাচ্চুর মেয়ে মিমি সেটা আমি জানতাম না।এই মূহুর্তে যদি বিয়েটা হয়ে যায় তাহলে মিমির পুরো লাইফটাই নষ্ট হয়ে যাবে।


#অবহেলা

#পর্ব _ ০১

#লেখক - #তানভীর_হৃদয়_নীল

Comments

Popular posts from this blog

ছাত্রদের জন্য Online হতে টাকা আয় করার ৬ টি সহজ টিপস